রজনীকান্ত সেন


       রজনীকান্তের গান মুখ্যতঃ ঈশ্বরানুভূতিতে ভাস্বর। বিরহ ব্যথা, ভক্তি, বিশ্বাস, আত্মসমর্পণ ইত্যাদি মনের আকুতি গভীর অনুভূতিতে জারিত হয়ে পরমার্থের সান্নিধ্যে সাদা ধাবমান। এ জীবনের ক্ষণিকতা, পরিজনের মায়া-মোহের বন্ধন, বৈভবের অসারত্ব তাঁর জীবন দর্শনের বিশেষ একটি দিক। জীবন যখন শুকায়ে যায়, সেই লগ্নে করুণাধারা আশে কবির মনে প্রাণ ঢালা ভক্তিরসাপ্লুত আত্মসমর্পিত সহজ সরল গানের ডালা, যে কোন সংবেদনশীল মনকে উধাও করে দিতে সক্ষম। বাহারী সুরের চাকচিক্য তথা ছন্দের জটিলতায় এতটুকু ভরাক্রান্ত না হয়ে কান্ত কবির গান যেন সুনিন্মল স্নিগ্ধতায় আকুল করা, মরমের আকুতি ভরা এক উচ্ছল আবেগের ঝরণাতলা।


       বাঙালি সমাজ এই অনিন্দ্যসুন্দর সুরের ঝরণাতলায় অবগাহন করে শ্বাশ্বত জীবনবোধ ও পবিত্রতায় তৃপ্ত। কান্ত কবির ভক্তি রসাপ্লুত গানে সুর প্রয়োগে যে সুগভীর আত্মনিবেদনের ভাবটি ফুটিয়ে উঠেছে তা অতি বিরল। ভাষার সারল্য, সহজ ছন্দ প্রকরণ ভক্ত মনকে ভক্তির জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেই চির প্রার্থিত চরম-পরমের সান্নিধ্যে। সুরের আবিলতা, ছন্দের জটিলতামুক্ত কান্ত কবির গান; এতটুকু পীড়া না দিয়ে অতি স্বচ্ছন্দে মনের গভীরে ভাবময়তার সুনিন্মল যে আলিম্পন এঁকে দেয়, তা প্রকাশ পায় শ্রোতার এক ফোঁটা পবিত্র চোখের জলে।  না পাওয়া ব্যথা, পেয়ে হারাবার যন্ত্রণা এবং শারীরিক অসুস্থতা, তাঁকে প্রতিনিয়ত ধূপের ন্যায় দহন করে শোধনের মাধ্যমে যে দুর্লভ জীবন বোধের সন্ধান দিয়েছে, সেই সুখহীন ভাব, রূপ পেয়েছে গানের ভাষায়। মনের গভীরে ব্যথা-বেদনা, হতাশা, পাপবোধ,  তাঁর হাত ধরে মুক্ত পাগল কবির মনে জন্ম নিয়েছে সুরধুনির  এবং তার স্রোতধারা নূপুর নিক্কণে লীলায়িত হয়েছে যে ছন্দ, তার প্রকাশ সাবলীল হওয়ায় স্বাভাবিক।


       রজনীকান্তের জীবন অনুধাবন করলে আমরা জানতে পারি যে, তিনি ধারাবাহিকভাবে রাগ সংগীত অনুশীলন করেন নি, তা সত্ত্বেও এ কথা অকুণ্ঠ চিত্তে বলা যায় যে ক্ষেত্রে বিশেষ গান তার গানে রাগের স্বর বিচ্যুতি, গান তথা রাগের ভাবরূপকে এতোটুকু খর্ব্ব বা ম্লান না করে এক নব রূপাঙ্কনে বিভুষিত, যা অতি সহজে এবং অনায়াসে মনের গভীরে স্থান করে নেয়। রজনীকান্ত, গানের ভাষা বা ভাবের দিশারী হিসাবে পল্লী সঙ্গীতের সুর অতি সুনিপণভাবে প্রয়োগ করে তিনি শিল্পী সত্তার অপূর্ব সাক্ষ্য রেখে গেছেন। তন্মধ্যে কীর্তন, বাউল, সারী ইত্যাদি গানের প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়। রজনীকান্তের সমগ্র গীত সংকলনকে পর্যায়ভুক্ত করতে গিয়ে আমরা মোট এই কয়টি ভাবধারার পরিচয় পায়। যথা- ভক্তি, বিশ্বাস, আত্মসমর্পণ, সমাজ সচেতনতা, প্রেম এবং হাস্যরস। যদিও কান্তকবির হাস্য রসাত্মক গানগুলি অনেকাংশেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ব্যঙ্গ গীতির অনুসারিক।


       পরিশেষে এই কথা বলা যায় যে, রজনীকান্তের গান সময়ের বিচারে বাঙালির মনে সব সময় বেঁচে থাকবে। কেননা তিনি গান যেন আমাদের একান্ত মরণের কথা, না বলা বাণী যা রূপ পেয়েছে তার গানে।

Post a Comment

Don't Share any links

Previous Post Next Post