ভারতীয় সঙ্গীতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস 


ভারতীয় সংগীত বহু প্রাচীনতার দাবি রাখে। বৈদিক যুগ হতেই সংগীত পরিব্যাপ্তি লাভ করেছে। সমবেদেও এই সংগীতের উল্লেখ আছে এবং বহু বিবর্তন এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আজও আমাদের সংগীত চিরভাস্বর হয়ে আছে। দুঃখের বিষয় এই যে প্রাচীনকালে সংগীত ছিল গুরুমুখীবিদ্যা। গুরুর কাছ হতেই শিষ্যপরম্পরায় চলে আসছে। ফলে ঔপপত্তিক বিষয় পুস্তক ও গানের বন্দেশ ধরে রাখবার জন্য স্বরলিপি না থাকায় আমাদের পূর্বপুরুষদের সংগীতের ধারা ঠিক কিরূপ ছিল তা আজ সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায় না। মুসলমান যুগ হতে প্রাচ্যের দুই সঙ্গীত ধারার সংমিশ্রণ ঘটেছিল এবং নব নব রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করেছিল।


আলাউদ্দিন খলজীর শাসন (১২৯৬ - ১৩১৬ খ্রিঃ) কালে আমীর খসরুই ছিলেন প্রথম এবং প্রধান ব্যক্তি, যাঁর সময় হতে হিন্দুস্থানী সংগীত নবরূপে প্রকাশিত হতে শুরু করে। এ সত্ত্বেও মহামতি আকবরের রাজত্বকালে (১৫৫৭ - ১৬০৫ খ্রিঃ) সংগীতের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। আকবর নিজেই ছিলেন বিদ্যুৎসাহী এবং অত্যন্ত উদার, সেইহেতু তাঁর রাজসভায় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক এবং সংগীতজগতের এক বিশেষ সমাবেশ ঘটেছিল। তাঁরই প্রেরণায় এবং উৎসাহে শিল্পের প্রতিটি দিকই তৎকালে বিশেষ উন্নতি লাভ করেছিল। মিঞা তানসেন, বৈজনাথ এবং অনেক গুণী শিল্পী তাঁর সভায় সভাগায়ক ছিলেন এবং বহু রাগের (দরবারী কানাডা, মিঞা-মল্লা, টোড়ী ইত্যাদি) সৃষ্টি হয়েছিল, বাদ্যযন্ত্রের আবিষ্কার হয়েও ধ্রুপদ গানের উন্নতি ঘটেছিল।


আকবরের পরবর্তীকালে মহম্মদ শাহের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মহম্মদ শাহের রাজত্বকালে (১৭১৯ খ্রিঃ) সদারঙ্গ অদারঙ্গ ও বহু কৃতি গায়ক তাঁর রাজসভায় আদৃত হয়েছিল। ফলে বর্তমান কলাবন্ত খেয়ালের প্রবর্তক হিসাবে আমরা সদারঙ্গকে পায় যাঁর সৃষ্ট বহু খেয়ালগান আজও প্রচলিত। পরবর্তীকালে নবাব ওয়াজেদ আলি শার নামও সংগীতজগতে বিশেষ উল্লেখ্য।  তাঁর সৃষ্ট ঠুংরি গান আজও বহু শ্রোতাকে মুগ্ধ করে। এককথায় মুসলমান রাজত্বকালে সংগীতের বিশেষ উন্নতি ঘটলেও বর্তমান কালেই অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হতে বিংশ শতাব্দীর আজ অবধি সংগীতের শ্রেষ্ঠ সময় বলা যেতে পারে। কারণ আমরা জানি পূর্বে সংগীত গুরুমুখীবিদ্যা হওয়ায় খুব কম সংখ্যক সংগীত অনুরাগীই সংগীত শিক্ষার সুযোগ পেতো।  শুধু তাই নয় তৎকালে সংগীত ছিল বংশানুক্রমিক; ফলে সংগীতগুরুরাও  নিজস্ব লোক ব্যতীত অন্যকে সংগীত শিক্ষা দিতে পরাঙ্মুক ছিলেন।


উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে পন্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডে, পন্ডিত বিষ্ণুদিগম্বর পালুষ্কর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়ভাই  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ক্রিয়াত্মক সংগীতকে স্বরলিপির মাধ্যমে সর্ব্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।  তার ফলে আজ বহু সংগীত প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাস্ত্রগত পঠন-পাঠন বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বর্তমান সরকার কর্তৃক সহযোগিতার ফলে আজ সংগীত সম্মেলন, কৃতি সংগীত শিল্পীদের পুরস্কার বিতরণ, রেডিও তথা দূরদর্শন দ্বারা উচ্চাঙ্গ  সংগীত প্রচার প্রভৃতি ব্যাপকভাবে সম্ভব হয়েছে এবং এর ফলে সংগীত আজ উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকারের আনুকুল্লে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক দল বিদেশেও আমাদের সংগীতকে বিশেষ সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রাচীন, মধ্য তথা বর্তমানকালে সংগীতজগতের পর্যালোচনা করলে এইরূপ প্রচার, প্রসার এতবেশি কোনকালে ঘটেছিল বলে ইতিহাসে সাক্ষ্য মিলে না। সুতরাং বর্তমান কালেকেই সংগীতের প্রচার ও প্রসারের শ্রেষ্ঠ সময়কাল বলা যেতে পারে।

Post a Comment

Don't Share any links

Previous Post Next Post