কাজী নজরুল ইসলাম 




বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুনিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে, ১৮৯৯ সালের ২৪শে মে  (১৩০৬ সনের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) মঙ্গলবার এক বিশেষ গরীব পরিবারে কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ্ ও মাতার নাম জাহেদা খাতুন। নজরুলের পিতা দুটি বিবাহ করেন, তাঁর সাত পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। সহোদর ভাইবোনের মধ্যে নজরুলের তিন ভাই ও এক বোন। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠ ভ্রাতা কাজী আলী হোসেন ও বোন উন্মে কুলসুম। চার ভ্রতার অকাল মৃত্যুর পর নজরুলের জন্ম হওয়ায় তাঁর নাম হয় দুখু মিয়া।



কাজী বংশ মূলত বিহার প্রদেশের হজীপুর নিবাসী হলেও সম্রাট শাহ আলমের রাজত্বকালে চুরুলিয়ায় এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। নজরুলের বাড়ির নিকটস্থ পীরপুকুরের প্রতিষ্ঠাতা সাধক হাজী পাহলোয়ানের মাজার শরীফ এবং একটি মসজিদের সেবাইৎ হিসাবে তাঁর পিতা ফকির আহমদ ও পিতামহ কাজী আমিনুল্লাহ সংসারের ভরণ পোষণ চালাতেন। নজরুল বাল্যকালে অত্যন্ত চঞ্চল স্বভাবের ও দুরন্ত ছিলেন। কোন শাসন অনুশাসনের ধার ধারতেন না। ফলে গ্রামবাসীরা তাঁর অত্যাচারে বিশেষ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে। মাত্র নয় বৎসর বয়সে (১৯০৮ সালে) পিতার অকাল মৃত্যুতে সংসারের সমস্ত দায়-দায়িত্ব তাঁর ওপর এসে পড়ে। ফলে ধারাবাহিক ভাবে তাঁর জীবনে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি। গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতেন। পরবর্তীকালে উক্ত মক্তবে শিক্ষকতা করে এবং গ্রামে গ্রামে মোল্লাগিরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর মেধা ও জ্ঞানপিপাসা স্কুলের বিধিবদ্ধ পড়াশুনার বাইরে যেখানে যা কিছু শিক্ষণীয় তাঁকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করত। তিনি ছিলেন স্বভাব উদাসীন, তাই তাঁকে লোকে তারাক্ষ্যাপা ও নজরআলি নামে অভিহিত করত। আর্থিক উপার্জ্জনের প্রয়োজনে তিনি লেটো গানে ভাষা ও সুর প্রয়োগ করে বিশেষ সুনাম অর্জন করেন। ফলে নিমসা, 

চুরুলিয়া এবং রাখাখুড়া এই তিনটি লেটো নাচের দলে নাটক রচনার ভার পান এবং ওই সময়ে বড় বড় ঐতিহাসিক নাটক ও 'মেঘনাদ বধ' নামে একটি রচনা করেন। লেটো গানের দলে থাকাকালীন ঢোল, বাঁশি তথা গান সৃজনে বিশেষ পারদর্শিতার পরিচয় দেন। হঠাৎ স্বভাব উদাসী নজরুল সবকিছু ছেড়ে বর্ধমান জেলার মাথরুন হাইস্কুলে ভর্তি হন। একদিন একজন বাঙালী ক্রিস্চান গার্ডসাহেব তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বাবুচির কাজ দেন।  কিছু দিন বাদে মালিকের সাথে হাঙ্গামার ফলে কাজ ছেড়ে দেন এবং আসানসোলে আব্দুল ওয়াহেদ্ নামে এক ব্যবসায়ীর রুটির দোকানে মাসিক পাঁচ টাকা বেতনের কাজ কাজে যোগ দেন। সারাদিন পরিশ্রম করা সত্ত্বেও সাহিত্যচর্চায় তাঁর এতকটু ভাটা পড়েনি। সেই সময় তাঁর গানে আকৃষ্ট হয়ে আসানসলের দারোগা রফিউদ্দিন আহমেদ্ ত্রিশালা থানার অন্তর্গত ময়মনসিংহ জেলার কাজী সিমলা গ্রামের দরিরামপুর হাইস্কুলে ফ্রি ছাত্ররূপে তাঁকে ১৯১৪ সালে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। তারই অব্যবহিত পরে ১৯১৫ সালে রানীগঞ্জে শিয়াড়শোল রাজস্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। তার মেধার পুরস্কার হিসেবে রাজবাড়ী থেকে মাসিক সাত টাকা বৃত্তি ও নিখরচায় পড়াশোনা এবং হোস্টেলে থাকার সুযোগ পান। ওই সময় প্রখ্যাত সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ঘটে এবং ক্রমে সেই পরিচয় গভীর বন্ধুত্বের পরিণত হয়। ১৯১৭ সালের পরীক্ষার সময় সাংসারিক প্রয়োজনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তিনি পল্টনে যোগদান করেন। সেখানে পাঞ্জাবী এবং মৌলবী সাহেবের সাথে পরিচয় ঘটে, তিনি ফরাসী সাহিত্যে সুপন্ডিত ছিলেন। তাঁরই প্রেরণায় এবং খুল্লতাতে কাজী বজল করিম ও শিক্ষক হাফিজ নুরুন্নবীর কাছে বাল্যকালে ফরাসী ভাষা শিক্ষালাভ করবার হেতু তিনি পল্টনে থাকাকালীন ফরাসি সাহিত্যে যথেষ্ট পড়াশোনা করার সুযোগ পান এবং ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।

Post a Comment

Don't Share any links

أحدث أقدم