অতুলপ্রসাদ সেনে
বাংলার সংগীত জগতে অতুলপ্রসাদ একটি স্মরণীয় নাম। যাঁর নাম বাংলার রসিক সংগীত শ্রোতার কাছে উজ্জ্বল হয়ে আছে এবং থাকবে।
তার পিতা রামপ্রসাদ সেন এবং মাতা হেমন্তশশী দেবী, যদিও মূলতঃ ফরিদপুর জেলার মগরগ্রামের অধিবাসী ছিলেন কিন্তু পরবর্তীকালে চিকিৎসক পিতা নিজ কর্ম্মোপলক্ষে ঢাকা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং চিকিৎসকরূপে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।
১৮৭১ সালে ২৫ শে অক্টোবর মতান্তরে ৩০ শে অক্টোবর ঢাকা শহরে অতুলপ্রসাদ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন।
মাত্র তেরো বছর বয়সে পিতার মৃত্যু হওয়ায় মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্ত মহাশয়ের তত্ত্বাবধানে অতুলপ্রসাদের পড়াশোনা চলতে থাকে। মাতুলালয়ে থাকাকালীন তাঁর সংগীতে হাতেখড়ি হয়। ১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়ে কিছুকাল অধ্যায়ন করেন এবং পরে ব্যারিস্টারী পড়ার জন্যে বিলেতে যান। যেখানে থাকার সময় পাশ্চাত্যের চিত্রকলা, নাটক এবং পাশ্চাত্য সংগীতের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হন এবং ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সংগীতের অধ্যায় একটি পুস্তক রচনা করেন। পুস্তকটি তৎকালীন বিদেশি গুণীজন দ্বারা বিশেষ আদৃত হয় ও খ্যাতিলাভ করে।
১৮৯৪ সালে ব্যারিস্টারি পাশ করে অতুলপ্রসাদ স্বদেশে ফিরে আসেন এবং প্রথমে কলিকাতা, রংপুর ও পরে লক্ষ্ণৌ শহরে স্থায়ী ভাবে ব্যবহারজীবির পেশা গ্রহণ করে বসবাস শুরু করেন। এই ক্ষেত্রেও তাঁর কৃতিত্ব ও খ্যাতি অনস্বীকার্য। তার ফলশ্রুতি স্বরূপ বার অ্যাসোসিয়েশন তিনি সভাপতির আসনে অভিষিক্ত হন। খ্যাতি, সম্মান এবং তার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে লক্ষ্ণৌর একটি রাস্তার নামকরণ হয় তাঁরই নামে। এটি তাঁর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসারই সাক্ষ্য বহন করে।
সাহিত্যে অনুরাগ অতুলপ্রসাদের আরে একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তিনি সারা জীবন সমস্ত কাজের মধ্যে থেকেও সাহিত্যের সেবা করে গেছেন। বারাণসী 'থেকে উত্তরা' নামে যে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় তা তাঁরই একান্ত প্রচেষ্টা ও অধ্যাবসায়ের ফলশ্রুতি। এ ছাড়া তিনি বেশ কয়েকবার "প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন" ও "নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের" সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন যা, তাঁর সাহিত্য প্রীতির পরিচয়ক। সম্ভবতঃ সংগীততীর্থ লক্ষ্ণৌ শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য এবং কিশোর বয়স থেকে জীবনের নানা কর্মের মধ্যেও সংগীতের প্রতি গভীর মমত্ববোধ হেতু তিনি এক নতুন বাংলা সংগীতের জন্ম দিয়ে গেছেন সেই সংগীত আজও সর্ব্বজনাদৃত অতুলপ্রসাদী সংগীত নামে পরিচিত।
কারও কারও বিশ্বাস তিনিই সর্ব্বপ্রথম বাংলা গানে রাগের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন ও ঠুংরি শৈলির মনোরম গায়কীকে বাংলা গানের প্রয়োগ করে বিশেষ বৈচিত্র্য এনেছেন। যা, আজ একটি নবধারার গতিময়তার ও রূপে-রসে ভাস্বর। কবির লেখনী ও সুরে প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ ইত্যাদি এবং ঠুংরি, গজল, টপ্পা, বাউল প্রভৃতি শৈলীর গান বাংলা সংগীতে একটি নবদিগন্তের উন্মেষ ঘটিয়েছে। তাঁর এই সংগীতের মধ্য দিয়ে আমরা প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে কবিকে একান্ত করে পায়।
যদিও তাঁর গানের সংখ্যা সীমিত তবুও এ কথা বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে, গুণগত বৈশিষ্ট্য ও প্রকাশের ভঙ্গিমায় তিনি আমাদের মনের গভীরে স্মৃতির মনিকোঠায় চিরন্তন হয়ে থাকবেন। প্রেমের করুণ রসে সিক্ত, বিরহীর না-পাওয়া বাঁশরীর সুর তাঁর গানে জীবন্ত রূপ পরিগ্রহ করে শ্রোতার মনকে নাড়া দিয়ে যায়। 'কাকলি', 'গীতিগুঞ্জে' প্রভৃতি কয়েকটি পুস্তকে তাঁর গানগুলি প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রধন্য অতুলপ্রসাদ ১৯৩৪ সালে ২৬ শে আগস্ট ৬৩ বছর বয়সে এই পার্থিব জগতের কর্মযজ্ঞ থেকে বিশ্রাম নিয়ে সুরলোকের অমর যাত্রায় পাড়ি দেন। কিন্তু আজও তার সৃষ্টি সুর আমাদের মনকে ছুঁয়ে যায়।
Post a Comment
Don't Share any links